ডাঃ এস এ মালেক, বিশিষ্ট রাজনৈতিক ও কলামিষ্টঃ
একদল বুদ্ধিজীবী ৬০ ও ৭০ দশকে প্রশ্ন তুলেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ কোন স¤প্রদায়ের কবি ছিলেন, হিন্দু না মুসলমান। প্রতিক্রিয়াশীল চক্র এরূপ ধারণার বশবর্তী হয়েছিলেন; যেহেতু রবীন্দ্রনাথ হিন্দু স¤প্রদায়ের একজন সদস্য তাই তিনি ঐ স¤প্রদায়ের কবি। ঠিক এরই প্রতিপক্ষ হয়ে ঐ সা¤প্রদায়িক প্রতিক্রিয়াশীল চক্র কবি নজরুলকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের প্রতিপক্ষ মুসলমান হিসাবে দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। তখন বাঙালী জাতীয়তাবাদকে প্রো-পাকিস্তানী বুদ্ধিজীবীরা ধর্তব্যের ভিতরে নিতেন না। তারা বক্তৃতা, বিবৃতি ও লেখনীতে একশবার বলতেন; তারা কিন্তু একবারও বাঙালী বলবার মতো মনমানসিকতা ছিল না, ধর্মরাষ্ট্র পাকিস্তানেই ছিল তাদের জাতিস্বত্ত¡ার উৎস। বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করে বাংলাভাষায় কথা বলে, বাংলাদেশের মাটি-জলে বর্ধিত হলেও; তারা নিজেদের বাঙালী বলে মনে করতেন না। অপরদিকে যে পাকিস্তানের প্রতি এত দরদ সেই পাকিস্তানীরা তাদের পাকিস্তানী ২য় বা ৩য় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে গণ্য করতেন এবং পূর্ব বাংলার সম্পদ লুন্ঠন করে তাদের সমৃদ্ধি সাধন করতেন। পাকিস্তানীরা ভেবেছিল, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালিয়েই একমাত্র বাঙালী জাতিসত্ত¡াকে দুর্বল করে যেতে পারে এবং বাঙালী জাতিসত্ত¡া দূর্বল হলেই বাঙালী জাতীয়তাবাদ আর কখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না। এ কথা সত্য নজরুল সাহিত্যে অনেক আরবি, ফারসি শব্দ আছে, এ কথাও সত্য যে, কবি নজরুল ইসলামিক মূল্যবোধ সংক্রান্ত অনেক কবিতা, গজল রচনা করেছেন। যদি মুসলমান হিসাবে বিবেচনা করা যায় তাহলে তিনি ছিলেন একজন খাঁটি ঈমানদার ব্যক্তি। কিন্তু ওটাই কি কবি নজরুলের একমাত্র পরিচয়। এদেশের ক’জন কবি আছেন যে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সংগ্রাম করেছিলেন।
বাংলা ভাষা ও বাঙালীত্বের জন্য তার সাংস্কৃতিক সংগ্রামকে কোনো প্রকারে খাটো করে দেখার অবকাশ আছে কি? তাই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ও তার কবিতায়, প্রবন্ধে, নাটকে, নজরুলের মতো একইভাবে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে কলম চালিয়েছেন। কবি নজরুলের প্রতিভা ও কাব্যিক দিক-দর্শন, রবীন্দ্রনাথের কাব্যিক দিক দর্শন হয়তো একই, বোলে অভিহিত করা যাবে না। রবীন্দ্র সংগীতের আবেগভরা আবেদন যেভাবে চিত্তকে বিমোহিত করে, নজরুলের বিদ্রাহীর কাব্য প্রতিভা তেমনী হৃদয়কে করে প্রকম্পিত। কোন মানুষেই পারিপার্শ্বিক প্রভাব হতে মুক্ত নয়। কবি নজরুল যে পরিবেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং যে পরিবেশে তিনি বড় হয়েছিলেন; রবীন্দ্রনাথের পরিবেশ ছিল তার সম্পূর্ণ বিপরীত। নজরুলের ছন্নছাড়া জীবনে দারিদ্রের কষাঘাতে নিপীড়িত হওয়ার যে করুণ বাস্তবতা রয়েছে, রবীন্দ্রনাথকে তা জীবনের বাস্তবতা দিয়ে নয়, কল্পনার মাধ্যমে তা অনুভব করতে হয়েছে। জীবনের বাস্তবতা ও কল্পনার প্রভাব যেমন ভিন্ন; নজরুল ও রবীন্দ্রনাথের জীবন দর্শনেও ঐরুপ কিছু ভিন্নতা রয়েছে। রুটির দোকানে কাজ করা থেকে শুরু করে, রাইফেল হাতে যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা নজরুলকে একজন বাস্তববাদী বিপ্লবী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। অপরদিকে সোনার তরীতে ভ্রমণ করে গ্রাম-বাংলার এখানে-ওখানে পলীচাষীদের করুণ জীবনযাত্রার প্রণালী যে গভীরভাবে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, তাকে এবং তার মনমানসিকতায় যে পরিবর্তন এসেছিল, কালমার্কসের ভাষায় শ্রেণীচ্যুত এক সমাজবিপ্লবী বললেও অত্যুক্তি হয় না। আমার মনে হয় আধ্যাত্মিকতা বলতে যা বোঝায় এই দুই মহাকবি ছিলেন তাতে বিশ্বাসী। রবীন্দ্রনাথ তার কবিতায় জীবন দেবতা বলতে যাকে বোঝানো হয়েছে; বিদ্রোহী কবি নজরুল তার বুকে পদচিহ্ন এঁকে দেওয়ার ভাষায় কবিতা লিখেছেন। কবিতার ভাষায় তা প্রকাশ করেছেন। অর্ন্তযামী কবিতায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির পিছনে সেই মহাশক্তির কাছে যেভাবে আত্মসমর্পণ করেছেন; তা মনে হয় আধ্যাত্মিকতার চরম নির্দশন।
বিদ্রোহী কবি নজরুল মৃত্যুর পর তাকে মসজিদের পাশে কবর দেওয়ার যে অনুরোধ জানিয়েছিলেন, তাও ছিল আধ্যাত্মিকতার প্রতি তার বিশ্বাসের পরম নিদর্শন। বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতায় বিশ্বাসী কবি ও সাহিত্যিকেরা যেভাবে সৃষ্টিরহস্য পেছনের মহাশক্তিকে আগ্রাহ্য করেছেন, সকল বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে মুক্তমনে বস্তুনিষ্ঠ বাস্তব জীবনের চিত্র তুলে ধরেছেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল ঠিক সেভাবেই বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতায় বিশ্বাসী হয়ে সাহিত্য কর্মে জীবন উপলব্ধি প্রতিষ্ঠিত করেছেন এরূপ দাবি করা বোধহয় ঠিক হবে না। কিন্তু মানবতাবাদী হয়ে মানুষের সুকমল বৃত্তিগুলোকে বিকশিত হওয়ার পথে এই দুই মহান কবি একইভাবে অবদান রেখেছেন।
দুই কবিকেই পরাধীন ভারতে জন্মগ্রহণ এবং জীবন-যাত্রা প্রণালী চালিয়ে যেতে হয়। কালের প্রভাব তাদের উপর পড়েছিল বলেই তারা ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন। কবি নজরুল ছিলেন, প্রায় সর্বহারা শ্রেণীর অর্ন্তভূক্ত। আর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ছিলেন জমিদার স¤প্রদায় কিন্তু চিন্তা ও মননশীলতায় তারা তাদের দেশের (বাঙালীর) এত নিকটতম হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন যে, তাদের তৃণমূল স¤প্রদায়ের অর্ন্তভূক্ত করলেও অত্যুক্তি হবে না। রাজনৈতিক সচেনতায় দুই কবি ছিলেন প্রকৃত অর্থে সমৃদ্ধ। দুঃখী, বঞ্চিত, শোষিত মানুষের প্রয়োজনেই তারা কাব্য, সাহিত্য রচনা করেছেন। একজন জমিদার পরিবারের সদস্য হয়েও ২ বিঘা জমির মতো কবিতা লিখে, তিনি শোষিত-বঞ্চিত নিচুতলার মানুষের এক করুণ চিত্র তুলে ধরেছেন, আর দুখু মিয়া তো প্রকৃত দুঃখীদের দুঃখ নিবারণের জন্যই শুধু কবিতা নয়, শ্রেণী সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছেন। তাই বলে রবীন্দ্রনাথ শুধু বাঙালীর কবি ছিলেন না, সর্বভারতীয় দিকদর্শনে তার হৃদয় ছিল সমৃদ্ধ। বিশ্ব পরিমন্ডলেও তৎকালীন আর্থ-সামাজিক সাংস্কৃতিক বাস্তবতা বিশেষ করে মানবতাবিরোধী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তার চিত্রকে বিশেষভাবে আলোড়িত করেছিল, যা তাকে নোবেল বিজয়ী করে। তিনি প্রথমে বাঙালীকে বিশ্ব পরিসরে পরিচিতি ঘটান। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সেই পরিচিতিতে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। বিপ্লবী নজরুল সরাসরি ঔপনিবেশিক বিরোধী সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছেন। উভয়ই বাংলা সাহিত্যের কবি, বাংলাভাষার-বাংলাদেশের কবি। একজন ছিলেন দীক্ষিত বিপ্লবের মন্ত্রে আর একজন আবদ্ধ ভালবাসার মায়াজালে রবীন্দ্র সংগীতের মায়াবী সুর হৃদয়ের কোমলতাকে যেভাবে স্পর্শ করে। নজরুলের যে বিদ্রোহী কবিতা ঠিক একইভাবে আগুন জ্বেলে দেয় হৃদয়ের মনি কোঠায়। দুইজন কবি বাঙালীত্ববোধে একক ও অদ্বিতীয়।
রবীন্দ্র সংগীত আজ বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে নতুন করে জাতীয় সংগীত লিখতে হয়নি। রবীন্দ্রনাথ নিখুঁতভাবে সে কাজটি করে গেছেন। আমাদের জাতীয় সংগীতে বাংলাদেশ ও বাঙালীর প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে, তাতে দৃষ্ট হয় রবীন্দ্রনাথের মনোজগতের প্রতিচ্ছবি। আর যখনই আমরা কিছু ভেঙ্গে আমরা গড়তে চাই, তখনই চল্রে চল্ নজরুলের গান গেয়ে জোর কদমে আমরা এগিয়ে চলার শপথ নেই। সা¤প্রদায়িকতার মন-মানসিকতা নিয়ে নজরুল ও রবীন্দ্রনাথকে বুঝবার চেষ্টা করেছেন, তারা নিজেদের মনের দোষ দৃষ্টতার কারণেই তা করে থাকেন। আসলে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল বাংলা সাহিত্যের দিকপাল। বাঙালী জাতির দিকদর্শন একশত বছর পরে রবীন্দ্রনাথ তার কবিতা পড়ার যে আবেদন জানিয়েছিলেন ঠিক একশত বছর পূর্বেই তার বাস্তবতা আজ মানুষের কাছে ধরা পড়েছে। কালজয়ী এই কবির কবিতা, গান শিল্পীর তুলিতে যা রেখে গেছেন; তা চিরন্তন সত্য হিসাবে আগামীতেও শত সহস্র বছর বিবেচিত হবে। ভবিষ্যৎকে বুঝবার এবং জানবার মহাপ্রতিভা নিয়ে রবি ঠাকুরের জন্ম হয়েছিল; তা কালজয়ী। বিশ্বসাহিত্যে বিরল ঘটনা। অপরদিকে সা¤প্রদায়িক মানমানসিকতা নিয়ে কবি নজরুলকে মুসলমান হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার অপচেষ্টা অতীতেও সফল হয়নি; এখনো হবে না। তার কবিতা হৃদয়ে যে অগ্নিসঞ্চার করে, তা বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দিতেই যথেষ্ট। যুগে যুগে তার মতো বিদ্রোহীর কন্ঠের আবির্ভাব হওয়ার প্রয়োজন। বিদ্রোহের আগুনেই রাখবে তাকে শ্বাশ্বত চিরঞ্জীব।
কবি সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, আবিস্কারক, লেখক কোন গন্ডীর মধ্যে আবদ্ধ নন। কোন ধর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যায় না। তাদের সৃষ্টিশীলতা সার্বজনীন। সমাজ, দেশ, জাতি সকলেই উপকৃত হন। এই সকল মহৎ ব্যক্তির সমৃদ্ধ জ্ঞানভান্ডার ধর্ম-বর্ণ-গোত্র, স¤প্রদায় নির্বিশেষে সকলের বুদ্ধিমত্তাকে উন্নত করে। সুতরাং রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে বিভাজন নয়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এবং সংস্কৃতি চর্চায় আমরা অবশ্যই দুই মহাকবির লেখনী থেকে প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করে বিশ্বসভ্যতায় অবদান রাখবো। মানব সভ্যতার উন্নতি আর সমৃদ্ধিতে জ্ঞানচর্চার কোনো বিকল্প নেই। বাংলা ভাষা, সাহিত্য এবং সংস্কৃতিচর্চায় আমরা অবশ্যই এই দুই মহাকবির জ্ঞানগর্ভ লেখনী থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে মানব সভ্যতাকে বিকশিত করতে ও বিশ্বশান্তি, কল্যাণ ও উন্নয়ণে নিরলসভাবে কাজ করে যাব। ধর্মে-ধর্মে, জাতিতে-জাতিতে সংঘাত দূর হোক। আমাদের এই দুই কবি তার ত্রিনয়ন দিয়ে বিশ্বভূবণকে দেখেছিলেন। মানব জাতি সৃষ্টির সেরা জীব। তাই ধর্মান্ধতা ও জাতিতে জাতিতে দ্ব›দ্ব-সংঘাত বিশ্বশান্তির জন্য হুমকীস্বরূপ। মহামনীষী ও মহাজ্ঞানীদের অবদান চিরস্মরণীয়। কারণ তাদের জ্ঞান প্রতিভার কারণে বিশ্বসভ্যতার আজ এত উন্নতি। ধর্মে-ধর্মে, জাতিতে-জাতিতে সংঘাত দূর হোক, মানবতার জয় হোক। বাংলা ভাষার এই দুই কবির কর্মময় সৃষ্টি যুগে যুগে আমাদের অনুপ্রেরণা ও শক্তি যোগাবে। ধর্মীয় স¤প্রীতি ও সুরক্ষায় বর্তমান সমাজে যত বেশি নজরুল ও রবীন্দ্রচর্চা হবে তত বেশি মানবসভ্যতা বিকশিত হবে।